ছাত্র আন্দোলনে গুলির নির্দেশদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা গা-ঢাকা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি ও হত্যাকা-ের নির্দেশ দাতা এবং সরাসরি গুলি করে ছাত্রদের হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা এখনও অধরা। অথচ দোষী পুলিশ কর্মকর্তা এবং নির্দেশদাতাদের বিচারের মুখোমুখি করা শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি। গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর গুলির ঘটনায় একের পর মামলা হচ্ছে। নির্দেশদাতা হিসেবে মামলার আসামি হচ্ছেন ওই সব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা ও আহত করে আওয়ামীলীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসব পুলিশ কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, যারা গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তারা এখনও পলাকত। ওই নির্দেশ দাতার মধ্যে অন্যতম পুলিশ প্রধান আবদুল্লাহ আল-মামুন, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন উর-রশীদ, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার বিশ্বাস ও মেহেদি হাসান, পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুর রহমান, পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, শিল্প পুলিশের সাবেক প্রধান মাহবুবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদস্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য্য, ডিএমপি সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার ও ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আব্দুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম। ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার সাবেক মো. মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো, মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দপ্তরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আলমগীর কবির, মো হামিদুল আলম, শেখ রফিকুল ইসলাম। ২১তম ব্যাচের মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, শ্যামল কুমার মুখার্জী, মো সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আসম মাহতাব উদ্দিন, মোহা আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো মোকতার হোসেন ও পংকজ চন্দ্র রায়। ২২তম ব্যাচের ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়।
২৪ বাচের ডিবি’র উপ-কমিশনার মশিউর রহমান (সদস্য সিএমপিতে বদলি), সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ। ২৫তম ব্যাচের ঢাকার সাবেক এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, ডিএমপি’র সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, কাজী আশরাফুল আজিম, জসিম উদ্দিন মোল্লা ও মো. শাহজাহানসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে। এর বাইরেও পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও থানার অনেক ওসির নামও আছে তালিকায়। সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট তাদের হদিস পাওয়া যায়নি। এদিকে, গুলির নির্দেশদাতাদের মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের রেঞ্জ ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) নাম পাওয়া গেছে।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কনস্টেবল আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মানুষ খুন করতে পুলিশের চাকরিতে আসিনি। আমরা নিজেরাও খুন হতে চাই না। বিসিএস কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানতেন। তারা ওয়্যারলেসে একটি ম্যাসেজ দিলে আমরা নিরাপদে যেতে পারতাম এবং এভাবে মরতে হতো না।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের প্রোটোকল অনুযায়ী, কোনো বড় জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে তাদের বাঁশি বাজিয়ে সরে যেতে বলা হয়। এরপর তাদের ধাক্কা দিয়ে, কাজ না হলে লাঠিচার্জ করে সরানোর চেষ্টা করতে হয়। পরবর্তী পদক্ষেপে ওপরে টিয়ারশেল ছুড়ে; তাতেও কাজ না হলে ফাঁকা গুলি করার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। পুলিশ যদি মনে করে তার মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে সেক্ষেত্রে তারা সোজা গুলি চালাতে পারবে। তবে, নিরস্ত্র কারো দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালানোর বিধান নেই। পুলিশ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালীন ঢাকা শহরে কেবলমাত্র যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে অনেক পুলিশের মৃত্যুঝুঁকি ছিল। তবে শাহবাগ, শহীদ মিনারসহ অনেক স্থানেই নিরস্ত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বহাল রাখার জন্য দলীয় কর্মীর মতো ভূমিকা পালন করেছেন এসব পুলিশ কর্মকর্তা। ছাত্র-জনতার রোষানলে টিকতে না পেরে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর পুলিশের কর্মকর্তারাই বিভিন্ন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করেছেন। চিহ্নিত হওয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন পলাতক। এছাড়া তাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন।